কলকাতার
রাজপথে আবারও নেমে এসেছে পুলিশের দমন-পীড়নের নির্মম চিত্র। ছাঁটাই হওয়া শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জবাবে প্রশাসনের নিষ্ঠুর আচরণ বারবার প্রশ্ন
তুলে দিচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উপর
এই রাজ্যের সরকারের অবস্থান।
গত শুক্রবার দুপুরে, কলকাতা পুলিশের সেন্ট্রাল ডিভিশনের নেতৃত্বে এক ভয়াবহ অভিযান
চালানো হয় ধর্মতলা, শিয়ালদহ,
ও এসপ্লানেড এলাকায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরি হারানো শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই বিকাশ ভবনের
সামনে শান্তিপূর্ণ ধর্নায় বসেছিলেন। এবার তাঁরা সচিবালয়
অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করতেই পুলিশ
তৎপর হয়ে ওঠে। এসএন
ব্যানার্জি রোড ও এসপ্লানেড
মোড়ে, পুলিশের হাতে গলা ধরা
অবস্থায় এক শিক্ষক বারবার
বলছিলেন, “ছেড়ে দিন, স্যার। আমাকে
ছেড়ে দিন।” কিন্তু তাঁর মানবিক অনুরোধ
শোনা তো দূরের কথা,
বরং তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে প্রিজন
ভ্যানে তোলা হয়।
প্রতিবাদীদের
ব্যাগ তল্লাশি, হেনস্থা, শিয়ালদহ থেকে বেরোতেই গ্রেফতার—সব মিলিয়ে শুক্রবার দুপুরটা ছিল যেন ভয়াল
দুঃস্বপ্ন। অনেক শিক্ষক পুলিশের
হাত এড়াতে চলন্ত ট্রামে লাফিয়ে উঠলেও, শেষ রক্ষা হয়নি।
সরকার
যে শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া শুনতে
প্রস্তুত নয়, তার প্রমাণ
মিলেছে প্রশাসনের প্রস্তুতিতে। সকাল থেকেই শিয়ালদহ
চত্বরে মোতায়েন ছিল ৮৪০ জন
কনস্টেবল, ২৫টি আরএএফ ব্যাটালিয়ন,
১২ জন ইন্সপেক্টর, ৬০
জন সাব-ইন্সপেক্টর, জলকামান
ও টিয়ার গ্যাস সহ। পুলিশের মূল
লক্ষ্য ছিল যেন কোনওভাবেই
মিছিল নবান্ন পর্যন্ত না পৌঁছায়। প্রতিবাদকারীরা
ধর্মতলা পৌঁছে নতুনভাবে মিছিল শুরু করতে চাইলেও,
পুলিশের দমন-পীড়ন সেখানে
আরও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। ডোরিনা
ক্রসিং-এর শপিং মল
থেকেও আন্দোলনকারীদের খুঁজে খুঁজে টেনে বের করে
গ্রেফতার করা হয়।
একজন
আহত শিক্ষক যখন ডিসি (সেন্ট্রাল)
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়কে বলেন, “পুলিশের ওপর আমাদের বিশ্বাস
নেই, আমরা কোথাও যেতে
চাই না,” তখন বোঝা
যায়, আন্দোলনকারীরা কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
পুলিশ ‘আইনের রক্ষক’ থেকে যেন ‘জনগণের
দমনকারী’-তে
পরিণত হয়েছে।
এদিকে
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার
ঘোষণা করেন, নতুন করে শিক্ষক
নিয়োগ করা হবে। কিন্তু
যারা আগে থেকেই যোগ্য
ছিলেন এবং অন্যায়ভাবে চাকরি
হারালেন, তাঁরা পুনরায় পরীক্ষা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই আপিল নিয়েই তাঁদের
আন্দোলন। তাঁদের বক্তব্য—“আমরা আবার পরীক্ষা
দিতে চাই না, আমরা
তো যোগ্য প্রমাণিত হয়েছি।”
ডিসি
(সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বলেন, “যারা ঝামেলা করতে
পারে, আমরা তাঁদের খুঁজছিলাম।
এলাকায় শান্তি বজায় রাখা আমার দায়িত্ব।” অথচ
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর এই নিপীড়ন
বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়। শিয়ালদহ
ও এসপ্লানেড এলাকা থেকে গ্রেফতার করা
হয় মোট ১৩২ জন
আন্দোলনকারীকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম নেতা চিন্ময় মণ্ডলও।
এই ঘটনাগুলো শুধু শিক্ষকদের ওপর
বর্বরতা নয়, এটি গণতান্ত্রিক
অধিকার হরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার
রুদ্ধদ্বার। একটা সভ্য সমাজে,
যেখানে শিক্ষকের মতো শ্রদ্ধেয় পেশার
মানুষরা রাস্তায় ন্যায্য অধিকার চাইতে গিয়ে মার খায়, গ্রেফতার
হয়—সেই সমাজে সরকারের
মুখ রক্ষা করার আর কোনো
যুক্তি অবশিষ্ট থাকে না। এই নৃশংসতা শুধু লজ্জাজনক নয়,
এটি গণতন্ত্রের কফিনে আরেকটি পেরেক। মানবিকতার নামে, ন্যায়বিচারের নামে—এই দমননীতি আজ
নিন্দনীয় ও চরমপন্থী এক
অপশাসনের নিদর্শন হয়ে রইল।
0 মন্তব্যসমূহ