Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

Recent in Home

সময়ের স্বর্ণরেণু | ধারাবাহিক উপন্যাস। প্রবীর রায় চৌধুরী

সময়ের স্বর্ণরেণু

ধারাবাহিক উপন্যাস। 
প্রবীর রায় চৌধুরী 


রবিবার স্কুল ছুটি , ভোর বেলা ওঠা নেই সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাঁত না মেজেই বাড়ির প্রকান্ড বাগানটা একরকম অকারণেই দৌড়ে এক চক্কর দিয়ে নিলাম  তার সাথে মুখে একটা আওয়াজ না করলে স্বাধীনতাটা ঠিক প্রকাশ পায় না   তাই তখনকার কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেনের হুইসিলের কুউউউ ঝিক ঝিক এর নকল একটা অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে যখন দৌড়টা প্রায় শেষ হয়েছে সামনের বারান্দার সিঁড়িতে এসে তখনই প্রায় আইকসিডেন্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছিল আরকি ব্যাপারটা কি ? বলছি তার আগে আমাদের বাড়ির ঘরগুলোর পজিশনতা বুঝে নেওয়া দরকার  প্রায় চার-পাঁচ বিঘা জায়গা জুড়ে , গাছপালা ভরা দুটি পুকুর সহ পুরোনো জমিদার বাড়ি  এই এতবড়ো বাগানের প্রায় মাঝখানে বাড়িটি অবস্থিত  চারপাশে ঘিরে থাকা চওড়া বারান্দা , মাঝখানে একটা বড়ো হলঘরের সমান ঘর , সেটিতে ঠাকুমা ছোটোপিসি থাকেন  ছোটোপিসি বিয়ে করেননি এবং বয়েসে বাবা-কাকা জ্যাঠামশাইয়ের ঠিক ওপরে  এই ঘরটির পুবদিকের বারান্দায় দুটি ঘর , তাতে ছোটোকাকার পরিবার , আর পশ্চিম দিকের বারান্দায় আমাদের দুটি ঘর  বড়ো পিসি বাড়িতে সবার বড়ো , বাল্য বিধবা মানুষ আর আছেন জ্যাঠামশাই  অগাধ পান্ডিত্য , কিন্তু যৌবনে কোনো আঘাতে সামান্য মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তাই চাকরি বাকরি তার আর করা হয়ে ওঠেনি  ছোটকাকা-কাকিমার একটি পুত্র সন্তান , আমার বাবা-মায়ের তাই  এই যে আমি  ওহ ,  বলা হয়নি , ছোটোপিসি আর ছোটকাকা আমাদের গ্রামের দুটি আলাদা স্কুলের যথাক্রমে শিক্ষিকা   শিক্ষক  আর আমার বাবা , কলকাতার সরকারি অফিসের কর্মচারী  তখন তো আমার ছোটবেলা , ক্লাস ফাইভে পড়ি সকালে স্কুল  তাই সপ্তাহের অন্য দিন গুলো সকাল হলেই মনে হতো যেন , সারা বাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছে , আর সবাই হইহই রইরই  করতে করতে ; কখনো একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কা গুতো লাগিয়ে , কখনো নিজেই চিৎপটাং হয়ে , আবার উঠে সেই অবস্থাতেই বাড়ি ছেড়ে পালতে চাইছে কারণটা আসলে সবার অফিস , স্কুলে বেরোনোর তাড়া  সেই সঙ্গে সেই মিছিলে আমরা ছোটরাও বাদ নেই  আমরাও তো স্কুলে যাব  শুধু মা -কাকিমা  বড়পিসি আর জ্যাঠামশাই থেকে যাবে  তখন মনে খুব ইচ্ছা হতো , ওদের মতো হওয়ার , কি মজা  ওদের ইস্কুলে যেতে হয় না 

আর একটা মিছিলও প্রায় একই সঙ্গে নানান বিচিত্র চিৎকার , বিভিন্ন দুর্বোধ্য মিশ্রভাষা ( পরে বুঝেছি সেগুলো বড়োদের গালাগালি ) সহকারে প্রায় একই বেগে সামনের গেট দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করছেএই মিছিলটি হলো বাড়ির ঝি-চাকরদের , বাগানের বাঁধা জন-মজুরদের  এই দুই বিপরীত-মুখী মিছিলে মিছিলে কখনো কখনো সংঘাত লেগে যেত  সেও এক মহা কলরব এর বিষয়  উদাহরণ - বাবা স্নান খাওয়া সেরে উঠোনে সাইকেলটা নামিয়ে একবার হ্যান্ডেলে ভীষণ চাপ দিয়ে দেখে নিলো , পাম্প ঠিক ঠাক আছে কিনা  ঠিক থাকলেও জবা গাছের গায়ে রাখা প্যাম্পারটা একবার করে দুচাকাতেই ঠেকিয়ে দু একবার ফোঁস ফোঁস করে পাম্প দিয়ে নিত. আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম , পাম্প টায়ারে ঢুকছে না - সব হওয়াটাই ভুস ভুস করে বেরিয়ে গেলো  এই কাজটা হয়ে গেলে , বাবা চারপাশটা একটু উঁকিদিয়ে দেখে নিলো  যেন সে একটা লজ্জা বা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে , কেউ দেখে ফেললো কিনা যাই হোক এবার বাবার অফিস বেরোনোর পরের ধাপ  এবাড়িতে উঠোনে সবার আলাদা বাগান করার জায়গা আছে  বাবারটা স্পেশাল  বাগান-পাগল মানুষ  শিয়ালদা থেকে নানা গাছের সবজির করা , দানা কিনে আনতো  আর নিজে হাতে তাদের পরিচর্যা করতো  এব্যাপারে বাড়ির জনমজুরদের মধ্যে বাবার খাস লোক ছিল রহিম চাচা তা বাবা যেই সাইকেলটা একটু দৌড়ে স্পিড নিয়ে লাফিয়ে উঠতে যাবে তখনি দেখে সামনে রহিম চাচা কোদাল কাঁধে বাড়িতে ঢুকছে  ব্যাস  বাবার আর সাইকেলে ওঠা হলোনা  সারা দিন রহিম চাচা কি কি করবে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে তবে শান্তি  চিতের দলের বেড়া রোজ কার ছাগলে ঢুঁসো মেরে ভাঙছে সেটা বাবা কিছুতেই ধরতে পারছে না  ফাইনালি সবটা বোঝানো হলে একবার হাতের ঘড়িটা দেখবে , এবং রোজই বলে উঠবে - এই তোর জন্য আজ দেরি হয়ে গেলো  বলেই ঝপাং করে লাফ দিয়ে সাইকেলে উঠে পড়বে  হাই স্পিডে পিতলের বেল বাজাতে সোজা একটানে স্টেশনে ছোটকাকা বলতো , তোর বাবা থাকতে এগ্রামে আগুন লাগবে না আগুন না লাগলেও সকালে আর রাতে দুবার এগ্রামে দমকলের গাড়ি ঘুরে বেড়ায়পরের  উদাহরণ ছোটোপিসি বনাম তরুনের মা  তার গলা একখানা বটে  তার স্বগোতক্তিতেও যেন ফিঙে, শিয়াল আর কাঁসি একসঙ্গে বেজে উঠতো  ঠাকুমা বাড়িতে থাকতেন বলে ছোটোপিসি ইস্কুলে থাকাকালীন খুবই টেনশনে থাকতেন  তাই বরুনের মাকে দেখেই তার দায়িত্বগুলো বুঝিয়ে দিতে লাগলেন  এটাকে দায়িত্ব বোঝানো না বলে , ট্রাফিক জ্যামে ট্যাক্সি ড্রাইভার আর বাইক চালকের কোনোদিন সমাধান হবে না এরকম বচসা বলাই ভালোছোটোকাকার বেরোনোটা তুলনায় মধুর ছিল  তবে বেরোনোর আগে বড়পিসির ঘরে গিয়ে  "দিদি বেরোলাম" বললেই পাশের ঘর থেকে জ্যাঠামশাই গম্ভীর গলায় হুঙ্কার আর আফসোস একইসঙ্গে প্রকাশ করে বলতেন - আমাকে বলে গেলিনা তো ! নিজেই সহবত শিখলি না , ইস্কুলে গিয়ে বাচ্চা গুলোর কেন মাথা খাচ্চিস ? আমি আজ থেকে তোর সাথে সব রকমের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলাম বলেই বিরাট একটা শাসন করা হয়েছে ভেবে হুহুহাহাহাহাহা... করে প্রাচীন সম্রাটদের স্টাইলে একটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন  শুনে বেরোনোর জন্য পা বাড়িয়ে ছোট কাকা রোজই চোখ কুঁচকে তীব্র শ্লেষে মাথা নাড়তে নাড়তে বলতেন - নাহ ! যাত্রা রোজ আর সহ্য হয়না বাপু  এটাকে গাড়িতে করে চিৎপুরে পাঠিয়ে দিতে হবে বলে ছোটকাকা গেট পার হয়ে যেতেন  পিছনে জ্যাঠামশাই তখনও যাত্রার স্বরে চিৎকার করে চলেছেন- ভীরু , কাপুরুষ , নরাধম তুমি , - ছোটোকাকাদের-ই নাটকের রিহার্সালের একটা পাঠ , যেখানে কর্ণ , অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে তিরস্কার করছে ...

"সম্মুখ সমরে না শুনো মহারথীর আহ্বান

অসি যুদ্ধে যদ্যপি যেত তব প্রাণ ,

নাহি নাহি খেদ তাহে

ছিন্ন শির পতিত মেদনী পরে ,

তবু , ধন্য ধরণী বলিত হর্ষ সহকারে

ধন্য ; ধন্য বীর তুমি

চিরবন্দিত , তব পেইন ভাবিকাল চাহে

তব আসন অক্ষয় যবে স্পর্শিল মম ভূমি।

হুহুহুহু... হাহাহাহাহাহা ..... "

কিরে পালাচ্ছিস কেন ?

তবে সকালের শুরুটা রোজ এভাবে হতোনা।  সেখানেও জ্যাঠামশায়ের অবিস্মরণীয় ভূমিকা। জ্যাঠামশাই প্রায় সারা রাত -ই জেগে কাটাতো।  রাতের খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির সব আলো নিভে যেত।  পুরোনামলের পাড়াগাঁ।  নিঃশব্দ , নিঝুম।  দূরে - কাছে মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক , রাতজাগা পাখির শিস , বকের ছানার কান্না , আর বাড়িতে পোষা প্রায় ডজন খানেক কুকুরের নানান রাতের আড্ডা ছাড়া মানুষের কোলাহল রাত দশটার মধ্যেই শেষ হয়ে ঘুমে কাদা।  আর তখনি জ্যাঠামশাইয়ের শিল্পকর্ম , নানা বিচিত্র বলাভালো কর্মকান্ড শুরু।  কখনো কর্ণ -কুন্তী সংবাদ , কখনো সিরাজদৌল্লা ; আবার আজ যদি শেক্সপিয়ারের সনেট তো কাল মাইকেলের মেঘনাদবধ।  বাগানের অসংখ্য গাছপালা কোনোদিন জ্যাঠামশাইয়ের বিপক্ষ যোদ্ধা , শত্রুপক্ষ ; আবার তারাই কখন তার ছাত্র , কখনো বা নীরব শ্রোতা।  অনভস্ত্য কেউ বাড়িতে রাত কাটালে আগে থেকে বিষয়টা ছোটোপিসি বুঝিয়ে বলে রাখতো , যাতে রাতে সে বা তারা ভয় পেয়ে দম আটকে না মরে।  হয়তো দেখলো জ্যোৎস্না রাতে বাড়ির বাগানে , মানে জঙ্গলে বলাই ভালো , ঘুরে বেড়াচ্ছে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পড়া কেউ একজন , দূর থেকে তার গলার আওয়াজ ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে।  আর যে কাঁচা ঘুম ভেঙে চোখ কোচলে জানলার ফাঁক দিয়ে এটা দেখছে , তার হৃদপিন্ড তত বুক ঠেলে গলার কাছে উঠে আসছে।  চেঁচাতে চাইছে কিন্তু কিছুই বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে।  হাত পা অসাড় হয়ে আসছে।  এমন সময় হয়তো জ্যাঠামশাই কোনো শত্রুপক্ষকে কাল্পনিক তাড়া করে প্রায় ধরে ফেলে উল্লাস সহকারে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো .. যেমনটা নড়ক গুলজার নাটকে ছিল।  মানে আগন্তুক বা অতিথি যখন বিছানায় খাবি খাচ্ছে ভূতের দর্শনে , র্যাম নাম জপার শক্তিও নেই , ঠিক সেই সময়ে সেই সাদা মূর্তি একেবারে জানলার গরাদের সামনে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলো - হাহাহাহাহা , আমি কাল শনি ....পশ্চাদে লাগিব যার মুক্ত কচ্ছো করিব তাহারে।  এদিকে সেই ঘর থেকে একটা মরণাপন্ন গোঙানি  আআআআ...  শোনা গেলো।  সারা বাড়ি ঘুম ভেঙে ছুতে সেই ঘরের দরজায়।  হৈহৈ রৈরৈ।  ছোটোপিসি দরজা ধাক্কা দিয়ে বলছে আপনি বেঁচে আছেন ? আপনি মানে জীবিত আছেন ?

ক্রমশ ...পরের সংখ্যায়

  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Comments

Ad Code