বাংলাদেশের ঔদ্ধত্যের জবাব! উত্তর-পূর্বকে কলকাতার সাথে জুড়তে সমুদ্রপথ, ঢাকা পড়ল ব্রাত্য
মানুষের ভাষা, ওয়েব ডেস্ক,
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিকে সরাসরি কলকাতার সাথে যুক্ত করার জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত সরকার। মেঘালয়ের শিলং-এর কাছে মওলিংখুং থেকে আসামের শিলচরের কাছে পঞ্চগ্রাম পর্যন্ত ১৬৬.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের জাতীয় সড়ক-৬ তৈরি হতে চলেছে। এই হাইওয়েটি শুধু উত্তর-পূর্বের প্রথম উচ্চ-গতির করিডোরই নয়, এটি মায়ানমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাল্টি-মোডাল পরিবহন প্রকল্পের সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সাথে কলকাতার বিকল্প সমুদ্রভিত্তিক যোগাযোগ স্থাপিত হবে, যা স্পষ্টতই বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে যাবে।
ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডের (NHIDCL) এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, এই প্রকল্পটি ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার আশা করা হচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রকের (MoRTH) অধীনে NHIDCL এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন করছে।
এই প্রকল্পের তাৎপর্য আরও বাড়ে যখন আমরা দেখি যে এটি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের একটি উপযুক্ত জবাব। এই বছরের মার্চ মাসে বেজিংয়ে ইউনূস বলেছিলেন যে উত্তর-পূর্ব ভারত "স্থলবেষ্টিত" এবং ঢাকা নাকি "এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক"। শুধু তাই নয়, তিনি "চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণ"ও কামনা করেছিলেন। ইউনূসের এই মন্তব্য ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল।
এর কয়েক দিন পর, ৪ঠা এপ্রিল ব্যাংককে বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে খবর, মোদী ইউনূসকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন যে "পরিবেশকে দূষিত করে এমন বাগাড়ম্বর এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়"। প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাংলাদেশের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের প্রতি ভারতের দৃঢ় অবস্থানের পরিচায়ক।
এই প্রেক্ষাপটে শিলং-সিলচর হাইওয়ে প্রকল্পের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। একদিকে যেমন এটি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মধ্যে দ্রুত এবং উন্নত যোগাযোগ স্থাপন করবে, তেমনি অন্যদিকে এটি বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে কলকাতা বন্দরের সাথে একটি বিকল্প বাণিজ্য পথ খুলে দেবে।
প্রকল্পের অন্য প্রান্তে, বিদেশ মন্ত্রকের অর্থায়নে মায়ানমারে কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে রাখাইন রাজ্যের কালাদান নদীর সিটওয়ে বন্দরের সাথে যুক্ত করছে। এরপর সিটওয়ে বন্দর অভ্যন্তরীণ জলপথের মাধ্যমে মায়ানমারের পালেতওয়া এবং সড়কপথে মিজোরামের জোরিনপুইয়ের সাথে সংযুক্ত হবে।
NHIDCL-এর ওই কর্মকর্তা আরও জানান, "NHIDCL জোরিনপুই থেকে লংলাই হয়ে মিজোরামের আইজল পর্যন্ত এই প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটি কেবল উত্তর-পূর্বের প্রথম উচ্চ-গতির করিডোরই নয়, পার্বত্য অঞ্চলেরও প্রথম এই ধরনের প্রকল্প। শিলং-সিলচর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ শিলচর মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মণিপুর সহ আসামের বরাক উপত্যকা অঞ্চলের সংযোগের প্রবেশদ্বার। সুতরাং, এটি সমগ্র উত্তর-পূর্বের জন্য একটি প্রধান সংযোগকারী লিঙ্ক এবং ভারতের 'অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি'র জন্য এই অঞ্চলকে একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হবে।"
কালাদান প্রকল্পের সহায়তায়, পণ্যবাহী জাহাজগুলি বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার না করেই বিশাখাপত্তনম এবং কলকাতা থেকে সরাসরি উত্তর-পূর্বে পৌঁছাতে পারবে। এরপর উচ্চ-গতির করিডোরের মাধ্যমে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করা যাবে, যা এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও গতি দেবে।
বর্তমানে, ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের একমাত্র সংযোগকারী পথ হল শিলিগুড়ি করিডোর, যা 'চিকেন'স নেক' নামেও পরিচিত। অন্যান্য দুটি প্রবেশপথ বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মাধ্যমে। তবে, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে প্রবেশাধিকার সীমিত করেছে এবং এই অঞ্চলে জলপথে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে, ভারত ও মায়ানমার যৌথভাবে কালাদান প্রকল্পকে একটি বিকল্প পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আশা করা হচ্ছে, শিলং-সিলচর হাইওয়ে নির্মাণের সময়কালের মধ্যেই এই সংযোগ পথটি সম্পূর্ণরূপে চালু হয়ে যাবে।
শিলং হাইওয়ের নির্মাণে ব্যাপক প্রকৌশলগত কাজ জড়িত, যার মধ্যে ভূমিধস প্রতিরোধের জন্য ঢাল স্থিতিশীল করা অন্যতম। কারণ এই রাস্তাটি দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাবে।
গত ৩০শে এপ্রিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ২২,৮৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে। প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্যের মধ্যে ১৪৪.৮ কিলোমিটার মেঘালয়ে এবং ২২ কিলোমিটার আসামে অবস্থিত। চালু হওয়ার পরে, এই নতুন রাস্তাটি ভ্রমণের সময় ৮.৩০ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে মাত্র ৫ ঘণ্টায় নিয়ে আসবে।
NHIDCL-এর কর্মকর্তা আরও জানান, এই নতুন হাইওয়ে শিলিগুড়ি করিডোরের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেবে। তিনি বলেন, "এই প্রকল্পটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি অত্যন্ত কঠিনও হতে চলেছে, কারণ এখানকার ভূখণ্ড খুবই দুর্গম এবং বিদ্যমান রাস্তার অবস্থাও ভালো নয়।"
ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণে উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ভূমিধসের পূর্বাভাস এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাল স্থিতিশীল করার আধুনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টপোগ্রাফিক্যাল সমীক্ষার জন্য লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং (LiDAR) স্ক্যানিং ব্যবহার করা হয়েছে। সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তিনটি সমাধান প্রস্তাব করা হয়েছে – রক অ্যাঙ্কর দ্বারা শক্তিশালীকরণ, উচ্চ শক্তির তারের জাল প্যানেল এবং সুরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ।
ঢাল স্থিতিশীল করার পরে এবং বিভিন্ন সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরে ঢাল পর্যবেক্ষণের জন্য আধুনিক যন্ত্র স্থাপন করা হবে। পিজোমিটার, রেইন গেজ, সেটেলমেন্ট গেজ, ইনক্লাইনোমিটার, জিওফোন ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামগুলি পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করা হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
জিওফোন ভূমিকম্প এবং ভূ-প্রযুক্তিগত প্রকল্পে কম্পন পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। ইনক্লাইনোমিটার পাহাড়ের ঢাল পর্যবেক্ষণে ভূমিধসের সম্ভাবনা বা ঢালের অস্থিরতা পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়। রেইন গেজ বৃষ্টিপাত পরিমাপ করে, সেটেলমেন্ট গেজ পাহাড়ের ঢালের মধ্যে উল্লম্ব স্থানান্তর বা বসতি পর্যবেক্ষণ করে এবং পিজোমিটার পাহাড়ের ঢালে জলের চাপ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়।
শিলং-সিলচর প্রকল্পটি হাইব্রিড অ্যানুইটি মোডে (HAM) বাস্তবায়িত হবে, যা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (PPP) একটি রূপ। এতে ১৯টি বড় সেতু, ১৫৩টি ছোট সেতু, ৩২৬টি কালভার্ট, ২২টি আন্ডারপাস, ২৬টি ওভারপাস, আটটি সীমিত উচ্চতার সাবওয়ে এবং ৩৪টি ভায়াডাক্ট থাকবে।
এই মেগা প্রকল্পটি কেবল উত্তর-পূর্বের যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই উন্নত করবে না, বরং বাংলাদেশের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের একটি বলিষ্ঠ জবাবও দেবে। ভারতের আত্মনির্ভরতা এবং আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
0 মন্তব্যসমূহ