'অযোগ্যদের বিভিন্ন দফতরে ফিরিয়ে দেবেন...যোগ্যদের কী হবে?' প্রশ্ন তুলছেন চাকরিহারা শিক্ষকরা, ক্ষোভে ফুঁসছে বিরোধী দলও
মানুষের ভাষা , ওয়েব ডেস্ক :
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২৪,০০০ এর বেশি স্কুল শিক্ষকের চাকরি বাতিলের পর রাজ্যজুড়ে এক নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। একদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিহ্নিত 'অযোগ্য' প্রার্থীদের জন্য বিকল্প পথের ইঙ্গিত দিয়েছেন, অন্যদিকে চাকরিহারা যোগ্য প্রার্থীরা এবং বিরোধী দলগুলি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ও চাকরিহারাদের পাল্টা প্রশ্ন:
মঙ্গলবার নবান্নে এক সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ঘোষণা করেন। তিনি জানান যে, OMR শিটে কারচুপির অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তারা নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন না এবং বেতনও পাবেন না – সুপ্রিম কোর্ট এ কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এরপরেও মুখ্যমন্ত্রী 'চিহ্নিত অযোগ্য'দের নিয়ে কথা বলেন এবং জানান, "যাঁরা বাতিল হয়ে গেছেন… তাদের বলা হয়েছে, তোমরা এই পরীক্ষায় বসতে পারবে না। তারা অন্য দফতরে যোগ দিতেই পারে।" তিনি আরও বলেন, "যাদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং যাদের বাতিল করা হয়েছে, তাছাড়াও অনেক শিক্ষক আছে, … ওরা শিক্ষা দফতরেও যোগ দিতে পারে। তাছাড়া আমরা আরও তিন-চারটে দফতরের অপশন দেব। কিন্তু, সেটা আমরা আলাদা করে নোটিফাই করব।"
মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পরই 'যোগ্য শিক্ষক - শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ ২০১৬' এর আন্দোলনরত সদস্যরা পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, "তাহলে আমরা কী দোষ করলাম!" তাদের প্রশ্ন, ৮-৯ বছর আগে যে প্রস্তুতি নিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, সেটা এখন হঠাৎ এই ক'দিনে তারা নেবেন কী করে?
চাকরিহারা শিক্ষিকা বিদিশা মুখোপাধ্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী এখনও অযোগ্যদের পাশে রয়েছেন। অযোগ্যদের বিভিন্ন দফতরে ফিরিয়ে দেবেন। তাহলে যোগ্যদের কী হবে? তাঁরা পরীক্ষা দেবেন? এখনও যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করতে পারল না। এর থেকে দুর্ভাগ্য কী হতে পারে।"
এদিন এবিপি আনন্দের 'যুক্তি-তক্কো' অনুষ্ঠানে এসে কোর্টের রায়ে চাকরিহারা শিক্ষক চিন্ময় মণ্ডল বলেন, "আমরা খুবই হতাশ। আমরা দেখলাম, হাইকোর্ট, নির্দেশ দিল সিবিআই তদন্ত করার। যখন সেই সিবিআই তদন্ত করে চার্জশিট জমা দিল, তখন দেখা গেল, সেই সিবিআই তদন্তকে কেউ মানছে না। তাহলে কী দরকার ছিল সিবিআই তদন্ত করার। সিবিআই অথরিটিটাকে রাখার কী দরকার…যদি তার রিপোর্টটাকে যদি না মানেন…" তিনি আরও যোগ করেন, "সরকার দুর্নীতি করল, পর্ষৎ দুর্নীতি করল, কমিশন দুর্নীতি করল, শাস্তি তাদের হওয়া উচিত…ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া উচিত।"
এর আগে ৭ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোরের সভা থেকেও মুখ্যমন্ত্রী অযোগ্যদের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছিলেন, "আগে যোগ্যদেরটা হয়ে যাক। বাদ বাকি যাঁরা থাকবেন যাঁদের অযোগ্য বলা হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ আছে আমি দেখব।"
বিরোধী দলনেতার হুঁশিয়ারি:আদালতে যাব
মুখ্যমন্ত্রীর এই সাংবাদিক বৈঠক ঘিরে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক করার এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেলে বিজেপির তেরঙ্গা যাত্রায় অংশগ্রহণ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শুভেন্দুবাবু বলেন, "মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক আসলে অশ্বত্থমা হত, ইতি গজ। সুপ্রিম কোর্ট তো SSCকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সেকথা ঘোষণা করলেন কেন? SSC একটি স্বশাসিত সংস্থা। মুখ্যমন্ত্রী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এটা বেআইনি। আমি এর বিরুদ্ধে আদালতে যাব।"
নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত:
মঙ্গলবার বিকেলে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান যে, ইচ্ছা না থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাঁদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হচ্ছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হবে ৩০ মে। ১৪ জুন পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। ১৫ নভেম্বর প্যানেল প্রকাশ হবে। ২০ নভেম্বর থেকে কাউন্সেলিং শুরু হবে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশে প্যানেল খারিজের ফলে যে ২৪,২০০ শূন্যপদ তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে আরও প্রায় ২০ হাজার শূন্যপদে নিয়োগ করবে সরকার। এর ফলে মোট প্রায় ৪৪ হাজার শূন্যপদে নিয়োগ হবে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, চাকরিহারাদের বয়সের ছাড়ের বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। চাকরিহারাদের অভিজ্ঞতার জন্য তাদের বাড়তি নম্বর দেওয়া যায় কি না সে ব্যাপারেও ভাবনা চিন্তা চলছে বলে মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
গ্রুপ C এবং গ্রুপ D কর্মীদের জন্য ঘোষণা:
এছাড়াও গত ১৭ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দেয় যে, শুধুমাত্র যে শিক্ষকরা 'দাগি' বা 'অযোগ্য হিসাবে চিহ্নিত' নন, ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁদের চাকরি বহাল থাকবে। আপাতত তাঁরা স্কুলে যেতে পারবেন ও বেতন পাবেন। তবে নতুন এই নির্দেশ গ্রুপ C এবং গ্রুপ D কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাই এদিন চাকরিহারা গ্রুপ C এবং গ্রুপ D কর্মীদের নিয়েও বিকল্প ভাবনার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, "আমরা অতিরিক্ত গ্রুপ C, D নিচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা শিক্ষা বিভাগে কাজ করতেন অথচ তাঁদের সবারটা বাতিল হয়ে গেছে, তাঁরা শিক্ষা বিভাগে আবেদন করতে পারবেন এছাড়াও তাঁদের জন্য আরও কয়েকটা বিভাগের বিকল্প দেব।"
বিরোধীদের কটাক্ষ:
মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকেই হাতিয়ার করে সরব হয়েছে বিরোধীরা। বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার কটাক্ষ, "অযোগ্যদের থেকেই তো টাকা পয়সা নিয়েছেন, চাকরি না দিলে তো চামড়া গুটিয়ে দেবে..."। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের প্রশ্ন, "দুর্নীতিগ্রস্তদের কেন তিনি নামের তালিকা বার করছেন না? কেন আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকার, পুলিশ, ডিডি, গোয়েন্দা বিভাগ… সবাই বলছে দুর্নীতি হয়েছে, এত টাকার লেনদেন হয়েছে, একটাকে ধরতে পারল না। কেন শাস্তি হল না?"
এই ঘটনাপ্রবাহের দিকে এখন রাজ্যবাসী তাকিয়ে আছে, কারণ একদিকে চাকরিহারাদের ভবিষ্যৎ, অন্যদিকে সরকারের স্বচ্ছতা এবং আদালতের নির্দেশ পালনের বিষয়টি প্রশ্নের মুখে।
0 মন্তব্যসমূহ