"বিচারকেরও ভুল হতে পারে", উন্নাও ধর্ষণকাণ্ডে কুলদীপ সেঙ্গারের জামিনে স্থগিতাদেশ দিয়ে কড়া মন্তব্য সুপ্রিম কোর্টের
উন্নাও ধর্ষণকাণ্ডে দোষী কুলদীপ সেঙ্গারের জামিন স্থগিত করল সুপ্রিম কোর্ট। দিল্লি হাইকোর্টের রায় নিয়ে কী বললেন প্রধান বিচারপতি? জানুন বিস্তারিত প্রতিবেদনে।
নিজস্ব প্রতিবেদন, নয়াদিল্লি: উন্নাও ধর্ষণকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে আপাতত জেলেই থাকতে হচ্ছে। দিল্লি হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের নির্দেশের ওপর সোমবার অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ জারি করল সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি সূর্যকান্তের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, আপাতত জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না সেঙ্গার।
কী ঘটেছিল আদালতে?
গত ২৩ ডিসেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট উন্নাও ধর্ষণ মামলায় কুলদীপ সেঙ্গারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা স্থগিত রেখে তাঁকে জামিন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় সিবিআই। সোমবার সেই আবেদনের শুনানিতে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা দাবি করেন, এটি একটি নাবালিকার ওপর নারকীয় অত্যাচারের ঘটনা। এখানে অভিযুক্ত একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও যে অপরাধ করেছেন, তাতে তাঁর জামিন পাওয়া উচিত নয়।
শুনানি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। হাইকোর্টের বিচারকদের সমালোচনা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে প্রধান বিচারপতি সূর্যকান্ত বলেন, "আমাদের বিচারকরা সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু আমাদের থেকেও ভুল হতে পারে।" অর্থাৎ, হাইকোর্ট যে এই সংবেদনশীল মামলায় জামিন দিয়ে ভুল করেছে, সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্য সেই দিকেই ইঙ্গিত করে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কেন সেঙ্গারের জামিন আটকাল শীর্ষ আদালত?
সিবিআই-এর পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয় যে, নির্যাতিতা ঘটনার সময় ১৬ বছরের কম বয়সী ছিল। পকসো (POCSO) আইন অনুযায়ী এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ।
সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জানায়:
১. সাধারণত হাইকোর্টের জামিনের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট সহজে হস্তক্ষেপ করে না, কিন্তু এই মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিশেষ ধরনের।
২. আদালত লক্ষ্য করেছে যে, কুলদীপ সেঙ্গার অন্য একটি মামলাতেও দোষী সাব্যস্ত এবং সেখানেও তাঁর জামিনের আবেদন ঝুলে রয়েছে।
৩. পকসো আইনের প্রয়োগ এবং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা হওয়া অপরাধের ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে আরও পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে।
নির্যাতিতার জন্য আইনি সহায়তা:
শুনানির সময় নির্যাতিতার আইনজীবীকেও আদালত জানায় যে, তাঁর আলাদা করে আবেদন করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল সার্ভিস অথরিটি তাঁকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেবে। আগামী ২০ জানুয়ারি এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
ফিরে দেখা উন্নাও কাণ্ড:
২০১৭ সালে উন্নাওতে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে উত্তাল হয়েছিল দেশ। ২০১৯ সালে দিল্লির একটি আদালত কুলদীপ সেঙ্গারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনায়। সেই সাজা স্থগিত রেখে হাইকোর্ট জামিন দিলেও, সুপ্রিম কোর্টের আজকের পদক্ষেপে সেই স্বস্তি হারালেন প্রাক্তন বিজেপি নেতা।
উন্নাও ধর্ষণ মামলা: এক লড়াকু তরুণী ও বিচার পাওয়ার দীর্ঘ ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ টাইমলাইন
২০১৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই মামলাটি কেবল অপরাধের কাহিনী নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালন এবং তার বিপরীতে সত্যের টিকে থাকার লড়াই। নিচে পর্যায়ক্রমে এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি তুলে ধরা হলো:
১. ঘটনার সূত্রপাত (জুন ২০১৭)
৪ জুন, ২০১৭: উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের এক নাবালিকা অভিযোগ করেন যে, চাকরির খোঁজে কুলদীপ সিং সেঙ্গারের (তদানীন্তন বিজেপি বিধায়ক) বাড়িতে গেলে সেঙ্গার তাকে ধর্ষণ করেন।
জুন-জুলাই ২০১৭: নির্যাতিতা এবং তাঁর পরিবার স্থানীয় থানায় অভিযোগ করার চেষ্টা করলেও পুলিশ প্রভাবশালী বিধায়কের ভয়ে এফআইআর (FIR) নিতে অস্বীকার করে।
২. নির্যাতিতার পরিবারের ওপর অত্যাচার (এপ্রিল ২০১৮)
৩ এপ্রিল, ২০১৮: নির্যাতিতার বাবা এবং পরিবারের সদস্যদের মারধর করে কুলদীপ সেঙ্গারের ভাই অতুল সিং এবং তাঁর অনুগামীরা। পরে উল্টে নির্যাতিতার বাবাকেই পুলিশ অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করে।
৮ এপ্রিল, ২০১৮: প্রশাসনের কোনো সাহায্য না পেয়ে লখনউতে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাসভবনের সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন নির্যাতিতা। এই ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
৯ এপ্রিল, ২০১৮: পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন হাসপাতালেই রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় নির্যাতিতার বাবার। তাঁর পিঠে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল।
৩. সিবিআই তদন্ত ও সেঙ্গার গ্রেফতার (এপ্রিল ২০১৮)
১২ এপ্রিল, ২০১৮: এলাহাবাদ হাইকোর্ট উত্তরপ্রদেশ সরকারকে কড়া ভর্ৎসনা করে এবং মামলাটি সিবিআই-এর (CBI) হাতে যায়।
১৩ এপ্রিল, ২০১৮: দীর্ঘ টালবাহানার পর অবশেষে সিবিআই কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে গ্রেফতার করে।
জুন ২০১৮: সিবিআই চার্জশিট পেশ করে এবং জানায় যে সেঙ্গার ও তাঁর ভাই সুপরিকল্পিতভাবে নির্যাতিতা ও তাঁর বাবাকে হেনস্থা করেছেন।
৪. প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ও সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ (জুলাই ২০১৯)
২৮ জুলাই, ২০১৯: রায়বেরেলিতে এক রহস্যজনক ট্রাক দুর্ঘটনায় নির্যাতিতা ও তাঁর আইনজীবী গুরুতর আহত হন। এই দুর্ঘটনায় নির্যাতিতার দুই কাকিমা প্রাণ হারান। অভিযোগ ওঠে, সেঙ্গার জেল থেকেই এই ষড়যন্ত্র করেছেন।
১ আগস্ট, ২০১৯: সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নির্দেশ দেন যে এই সংক্রান্ত পাঁচটি মামলাই লখনউ থেকে দিল্লির তিস হাজারি আদালতে স্থানান্তরিত করতে হবে।
আগস্ট ২০১৯: দেশজুড়ে ক্ষোভের মুখে বিজেপি কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে দল থেকে বহিষ্কার করে।
৫. ঐতিহাসিক সাজা (ডিসেম্বর ২০১৯)
১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯: দিল্লির বিশেষ আদালত কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে নাবালিকা ধর্ষণের দায়ে (পকসো আইন ও আইপিসি) দোষী সাব্যস্ত করে।
২০ ডিসেম্বর, ২০১৯: আদালত সেঙ্গারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫ লক্ষ টাকা জরিমানার সাজা শোনায়।
মার্চ ২০২০: নির্যাতিতার বাবার মৃত্যু মামলার রায়েও সেঙ্গার এবং তাঁর ভাই অতুল সিংকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
৬. সাম্প্রতিক নাটকীয়তা (ডিসেম্বর ২০২৫)
২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫: দিল্লি হাইকোর্ট কুলদীপ সেঙ্গারের সাজা স্থগিত করে তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫: সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে। প্রধান বিচারপতি জানান, "বিচারকেরও ভুল হতে পারে"। ফলে সেঙ্গারকে আবার জেলেই থাকতে হচ্ছে।
| সাল ও তারিখ | ঘটনাপ্রবাহ | মূল বিষয়বস্তু |
| জুন ২০১৭ | ধর্ষণের অভিযোগ | ভরতপুর (উন্নাও)-এর বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারের বাড়িতে চাকরির খোঁজে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন নাবালিকা। |
| এপ্রিল ২০১৮ | বাবার মৃত্যু ও বিক্ষোভ | পুলিশের অসহযোগিতায় মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে নির্যাতিতার আত্মহত্যার চেষ্টা। পরদিন পুলিশ হেফাজতে নির্যাতিতার বাবার রহস্যমৃত্যু। |
| ১৩ এপ্রিল ২০১৮ | সিবিআই-এর জালে সেঙ্গার | এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে মামলা সিবিআই-এর হাতে যায়। গ্রেফতার হন প্রভাবশালী বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার। |
| ২৮ জুলাই ২০১৯ | রহস্যজনক দুর্ঘটনা | রায়বেরেলিতে নির্যাতিতার গাড়িতে ট্রাকের ধাক্কা। দুই কাকিমার মৃত্যু, নির্যাতিতা ও তাঁর আইনজীবী আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। |
| ১ আগস্ট ২০১৯ | সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ | তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর নির্দেশে মামলাটি উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লির বিশেষ আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়। |
| ডিসেম্বর ২০১৯ | যাবজ্জীবন কারাদণ্ড | দিল্লির তিস হাজারি আদালত কুলদীপ সেঙ্গারকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫ লক্ষ টাকা জরিমানার নির্দেশ দেয়। |
| মার্চ ২০২০ | দ্বিতীয় সাজা | নির্যাতিতার বাবাকে খুনের দায়ে সেঙ্গার ও তাঁর ভাইকে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। |
| ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ | হাইকোর্টের বিতর্কিত জামিন | দিল্লি হাইকোর্ট মানবিকতার খাতিরে বা সাজা স্থগিত করে সেঙ্গারকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেয়। |
| ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ | সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ | সিবিআই-এর আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের জামিনের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, "বিচারকেরও ভুল হতে পারে"। |
কেন এই মামলাটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
১. এটি প্রমাণ করে যে আইন সবার জন্য সমান, এমনকি সে যদি কোনো শাসকদলের প্রভাবশালী বিধায়কও হন।
২. সুপ্রিম কোর্টের কড়া নজরদারি না থাকলে উত্তরপ্রদেশের স্থানীয় পুলিশ এই মামলাটি ধামাচাপা দিয়ে দিত।
৩. পকসো (POCSO) আইনের কঠোর প্রয়োগ এই মামলার মাধ্যমেই দেশবাসী স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করেছে।
Keywords: কুলদীপ সিং সেঙ্গার জামিন, উন্নাও ধর্ষণ মামলা সুপ্রিম কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট লেটেস্ট নিউজ, প্রধান বিচারপতি সূর্যকান্ত, পকসো আইন অপরাধ।
0 মন্তব্যসমূহ