মানবাধিকারের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিল মাদ্রাজ হাই কোর্ট। সমলিঙ্গ সম্পর্কের একটি মামলায় রায় দিতে গিয়ে হাই কোর্টের বিচারপতি জি আর স্বামীনাথন এবং ভি লক্ষ্মীনারায়ণনের ডিভিশন বেঞ্চ জানাল, “পরিবার” শব্দের ব্যাখ্যা এখন আর কেবল ঐতিহ্যগত গণ্ডিতে আবদ্ধ নয় — এটি একটি প্রসারিত ধারণা, যেখানে সমলিঙ্গ যুগলরাও পরিবার গঠন করতে পারে।
এই রায়টি এসেছে জুন মাসে — যেটি বিশ্বজুড়ে “প্রাইড মাস” হিসেবে উদযাপিত হয় LGBTQIA+ কমিউনিটির অধিকার, আত্মসম্মান এবং সমানাধিকারের বার্তা নিয়ে। তাই এই সময়ে এমন একটি রায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতীকী।
মামলার সারাংশ
একজন ২৫ বছর বয়সী তরুণীকে তার পরিবারের হেফাজত থেকে মুক্তি দিয়ে তার মহিলা সঙ্গীর সঙ্গে থাকার অনুমতি চেয়ে দায়ের হয় হেবিয়াস কর্পাস মামলা। শুনানির সময় সেই তরুণী জানিয়েছেন, তিনি সমকামী এবং আবেদনকারী মহিলা তার প্রেমিকা। তিনি দাবি করেন, তার পরিবার জোরপূর্বক তাকে ঘরে আটকে রেখেছে, মারধর করেছে এবং এমনকি তাকে তথাকথিত “স্বাভাবিক” করে তোলার জন্য কিছু ধর্মীয় আচারেও বাধ্য করেছে। কোর্ট জানিয়েছে, “আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, সেই তরুণী স্বেচ্ছায় আবেদনকারীর সঙ্গে থাকতে চায় এবং তার পরিবার তাকে জোর করে আটকে রেখেছে। তাই তাকে মুক্তি দেওয়া হল এবং পরিবারের সদস্যদের তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করা হচ্ছে।”
সমলিঙ্গ যুগল ও “পরিবার” সংজ্ঞা
রায়ে আদালত বলেন, যদিও সুপ্রিম কোর্ট এখনো সমলিঙ্গ বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও সমলিঙ্গ যুগল একটি পরিবার গঠন করতে পারে। “বিয়ে পরিবার গঠনের একমাত্র উপায় নয়,” আদালত জানায়। তারা আরও উল্লেখ করেন, LGBTQIA+ আইনি পরিসরে “chosen family” বা নির্বাচিত পরিবার গঠনের ধারণাটি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। এ ক্ষেত্রে আবেদনকারী এবং তরুণী – এই দুই নারী একটি পরিবার হিসেবেই বিবেচিত হতে পারেন।
আইনি ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
এই রায় শুধু একটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষা নয়, বরং সমাজে পরিবার, ভালোবাসা ও আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দেয়। সুপ্রিম কোর্টের NALSA ও নৱতেজ জোহর মামলার রায় উল্লেখ করে হাই কোর্ট বলেছে, যৌন ঝোঁক ব্যক্তিগত স্বাধীনতারই অঙ্গ — এবং তা সাংবিধানিক সুরক্ষায় পড়ে।
প্রাইড মাস এমন এক সময়, যখন LGBTQIA+ কমিউনিটি তাদের অস্তিত্ব, অধিকার ও গর্ব উদযাপন করে। এই মাসে এমন এক রায়ের মাধ্যমে আদালত যেন কেবল আইন নয়, ভালোবাসার সম্মানও প্রতিষ্ঠা করল। এটি ভারতের LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের জন্য এক আশার আলো — যে, তারা আইনের চোখেও মর্যাদা পাওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে।
মাদ্রাজ হাই কোর্টের এই রায় ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাংবিধানিক অধিকার এবং মানবিক মর্যাদার প্রতি প্রতিশ্রুতির বহিঃপ্রকাশ। প্রাইড মাসে এই বার্তা যেন আরও উচ্চকিত হল — ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা কিছু নয়, এটি গর্ব করার মতো একটি অনুভব। এবং সেই ভালোবাসা যখন সমসম্মত, তখন তা অবশ্যই সুরক্ষিত এবং মর্যাদাপূর্ণ হওয়া উচিত — আইনের চোখেও।
0 মন্তব্যসমূহ