অভিষেকের গ্রেফতারি ও সেটিং তত্ত্ব নিয়ে মুখ খুললেন অমিত শাহ ! তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি ও 'সেটিং' তত্ত্ব নিয়ে মুখ খুললেন অমিত শাহ! প্রেস কনফারেন্সে যা বললেন তাতে তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি।

Image- India Today

কলকাতায় অমিত শাহের সংবাদ সম্মেলন: মূল প্রতিবেদন

তারিখ: ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫

স্থান: কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

উপস্থিত ছিলেন: বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এবং শান্তনু ঠাকুর।

প্রথম অংশ: অমিত শাহের ভাষণ (সারসংক্ষেপ)

অমিত শাহ তাঁর বক্তব্য শুরু করেন আজকের দিনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব দিয়ে। তিনি বলেন, "আজ ৩০শে ডিসেম্বর ভারতের জন্য এক গর্বের দিন। ১৯৪৩ সালের আজকের দিনেই বাংলার মহান সন্তান নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পোর্ট ব্লেয়ারে প্রথমবার স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।"

তিনি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, "আজ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাংলার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এপ্রিলে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বাংলার মানুষের মধ্যে আমি ভয়, দুর্নীতি, অপশাসন এবং অনুপ্রবেশের বদলে ঐতিহ্য, বিকাশ এবং গরিব কল্যাণের এক মজবুত সরকার গড়ার সংকল্প দেখতে পাচ্ছি। তৃণমূলের ১৫ বছরের শাসনে মানুষ আতঙ্কিত এবং আশঙ্কিত।"

বিজেপির প্রতিশ্রুতি:

অমিত শাহ আশ্বাস দেন যে, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে বাংলার ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করা হবে। তিনি বলেন, "আমরা এমন এক মজবুত 'ন্যাশনাল গ্রিড' তৈরি করব যাতে বাংলা থেকে অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ তো দূরের কথা, একটা পাখিও যাতে গলতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে। শুধু অনুপ্রবেশ আটকানো নয়, প্রত্যেক অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে।"

মমতা সরকারের সমালোচনা:

তিনি অভিযোগ করেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দুর্নীতির কারণে বাংলার বিকাশ থমকে গেছে। কেন্দ্রের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো এখানে 'টোল সিন্ডিকেট'-এর বলি হয়েছে। তিনি ২০২৬ সালের ১৫ই এপ্রিলের পর বিজেপি সরকার গঠনের পর বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্নের বাংলা গড়ার ডাক দেন।

নির্বাচনী পরিসংখ্যান ও জয়ের দাবি:

অমিত শাহ পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০১৪ সালে বিজেপি ১৭% ভোট পেয়েছিল, ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৪১% এবং ২০২১-এ ৩৮% ভোটে ৭৭টি আসন পেয়েছে। তিনি দাবি করেন, "যে দল ৩টি আসনে ছিল, তারা ৫ বছরে ৭৭টি আসনে পৌঁছেছে। অন্যদিকে কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা শূন্যে নেমে গেছে। ২০২৪-এর লোকসভাতেও আমরা ১২টি আসন পেয়েছি। ২০২৬-এ আমরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ব।"

অনুপ্রবেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা:

অনুপ্রবেশ ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি আক্রমণ করে তিনি বলেন, "কেন শুধুমাত্র বাংলাতেই অনুপ্রবেশ হচ্ছে? আসাম, ত্রিপুরা বা রাজস্থানে কেন হচ্ছে না? কারণ আপনার নজরদারিতে অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে যাতে জনবিন্যাস পরিবর্তন করে ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করা যায়। এটি এখন আর শুধু বাংলার বিষয় নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়।"

দুর্নীতি ও নারী নিরাপত্তা:

তিনি এসএসসসি, রেশন, কয়লা ও গরু পাচার সহ একাধিক দুর্নীতির তালিকা তুলে ধরেন এবং জেলে থাকা মন্ত্রীদের নাম উল্লেখ করেন। নারী নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি আরজি কর ও সন্দেশখালির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, "নারীদের সন্ধ্যা ৭টার পর বেরোতে নিষেধ করা হচ্ছে, আমরা কি মুঘল যুগে বাস করছি?"

অর্থনৈতিক পতন:

তিনি বলেন, একসময় ভারতের জিডিপিতে বাংলার অবদান ছিল ১০.৫%, যা এখন কমেছে। আগে বাংলার মানুষের আয় জাতীয় গড় আয়ের চেয়ে ১২৭% বেশি ছিল, এখন তা কমে ৭৩% এ দাঁড়িয়েছে। ৭০০০-এর বেশি কোম্পানি ২০১১ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে বাংলা ছেড়ে চলে গেছে।

দ্বিতীয় অংশ: প্রশ্নোত্তর পর্ব (Question & Answer Session)

প্রশ্ন ১ (রাজু চক্রবর্তী, বর্তমান): বিজেপি কি ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বের নেতাদের অবসরে পাঠানোর নিয়ম কঠোরভাবে পালন করবে?

উত্তর: অমিত শাহ হাসিমুখে বলেন, "আপনি বাংলার চিন্তা করুন ভাইয়া, আমার পার্টির চিন্তা কেন করছেন?"

প্রশ্ন ২: মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এসআইআর (SIR) প্রক্রিয়ার নথি নিয়ে আতঙ্ক আছে, আপনার মন্তব্য কী?

উত্তর: "মতুয়াদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, যারা শরণার্থী হিসেবে এসেছেন তারা ভারতের নাগরিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না।"

প্রশ্ন ৩ (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস): গত নির্বাচনে দেখা গেছে আপনাদের বুথ স্তরের সংগঠন তৃণমূলের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। এবার কি আপনারা তৈরি?

উত্তর: "আমরা ৩ থেকে ৭৭-এ পৌঁছেছি। আমাদের ভোট বেড়েছে। বুথ স্তরে আমাদের কাজ পৌঁছে গেছে বলেই ১৮টি লোকসভা আসন জেতা সম্ভব হয়েছে। আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।"

প্রশ্ন ৪ (দূরদর্শন): কলকাতায় মেট্রো প্রকল্পের কাজ বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে। কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত কি এর কারণ?

উত্তর: "কেন্দ্র সব রাজ্যে সমানভাবে কাজ করে। তামিলনাড়ু বা তেলেঙ্গানায় সমস্যা হয় না, শুধু বাংলাতেই কেন? কারণ মেট্রো তো আর হাওয়ায় চলবে না, জমি লাগবে। জমি থেকে জবরদখল উচ্ছেদ করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। মমতা সরকার উন্নয়নের প্রতিটি কাজে বাধা দিচ্ছে।"

প্রশ্ন ৫ (এএনআই): অনুপ্রবেশ রুখতে বিএসএফ কেন ব্যর্থ হচ্ছে বলে রাজ্য অভিযোগ করে?

উত্তর: "বিএসএফ তখনই সুরক্ষা দিতে পারে যখন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থাকে। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্য মমতা সরকার জমি দিচ্ছে না। আমি নিজে ৭টি চিঠি লিখেছি। রাজ্য সরকার অনুপ্রবেশকারীদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তাই তারা সহযোগিতা করে না।"

প্রশ্ন ৬: কেন্দ্র কি বাংলার জন্য বরাদ্দ ফান্ড আটকে রেখেছে?

উত্তর: "তাদের এই বিরোধ এখন আর কেউ গুরুত্ব দেয় না। ভারত সরকার যে কোনো ভালো কাজ করলেই তারা বিরোধ করে। এটি তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে।"

প্রশ্ন ৭: বিজেপি ক্ষমতায় এলে কি রাজ্যের বর্তমান জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেবে?

উত্তর: "এটি অপপ্রচার। বিজেপি সরকার আসার পর একটিও বর্তমান প্রকল্প বন্ধ হবে না। বরং আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যা থাকবে, তা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।"

প্রশ্ন ৮: বাংলায় মন্দির-মসজিদ নিয়ে যে রাজনীতি চলছে, তাতে কি শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে?

উত্তর: "এই রাজনীতি কারা করছে? তৃণমূলের বিধায়করাই তো এসব করছে। আমি তো মন্দির তৈরির উদ্যোগকে স্বাগত জানাই, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দেরি করে ফেলেছেন। মানুষের আসল সমস্যা বেকারত্ব, নিরাপত্তা এবং দুর্নীতি।"

প্রশ্ন ৯ (জি ২৪ ঘণ্টা): বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে কি কোনো 'সেটিং' আছে? কেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না?

উত্তর: "বিজেপি কোনো এজেন্সির কাজে হস্তক্ষেপ করে না। এজেন্সি আইনি কাজ করবে। আমরা কাউকে বাঁচাব না, আবার কাউকে ভয়ও পাব না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপশাসনের বিরুদ্ধে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করব এবং তৃণমূল সরকারকে উপড়ে ফেলব।"

প্রশ্ন ১০: আপনার লক্ষ্যমাত্রা কী?

উত্তর: "আমি আগেই বলেছি, দুই-তৃতীয়াংশ (2/3rd) সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আমরা সরকার গড়ব।"

অমিত শাহ পরিশেষে জনগণকে করজোড়ে নিবেদন করেন যে, কংগ্রেস, বাম এবং তৃণমূলকে সুযোগ দেওয়ার পর এবার বিজেপিকে একবার সুযোগ দেওয়া হোক 'সোনার বাংলা' গড়ার জন্য।