এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি: 'র্যাঙ্ক জাম্প' করে চাকরিপ্রাপ্তরা পরীক্ষায় বসতে পারবেন না, সুপ্রিম কোর্টের কড়া নির্দেশ
মানুষের ভাষা, ওয়েব ডেস্ক :
পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) নিয়োগ প্রক্রিয়ায় 'র্যাঙ্ক জাম্প' করে যারা চাকরি পেয়েছিলেন, তাদের জন্য এক বিরাট ধাক্কা এল সুপ্রিম কোর্ট থেকে। শীর্ষ আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এই 'অযোগ্য' (দাগি বা টেন্টেড) হিসেবে চিহ্নিত প্রার্থীরা নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারবেন না এবং পরীক্ষায় বসার সুযোগও পাবেন না। এই নির্দেশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কড়া অবস্থানেরই প্রতিফলন, যা রাজ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
'সুপ্রিম' নির্দেশ ও 'র্যাঙ্ক জাম্প'-
এসএসসি-র নিয়োগপ্রক্রিয়ায় 'র্যাঙ্ক জাম্প' করে যারা চাকরি পেয়েছিলেন, তাদের নতুন করে পরীক্ষায় বসার আর্জি খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালত জানিয়েছে যে, এ বিষয়ে দেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না যে রায় দিয়েছিলেন, তা একেবারে সঠিক। এর ফলে, চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকা বা শিক্ষাকর্মীরা নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন না এবং পরীক্ষায় বসতে পারবেন না।
'র্যাঙ্ক জাম্প' কী?
'র্যাঙ্ক জাম্প' বলতে বোঝানো হচ্ছে এসএসসি-র মেধাতালিকার ক্রম বা 'র্যাঙ্ক'-এ পিছিয়ে থেকেও অন্যদের টপকে উপরে উঠে আসা। যারা এভাবে চাকরি পেয়েছেন, তাদেরও 'অযোগ্য' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের চাকরি পাওয়ার ফলে ক্রমতালিকায় উপরে থাকা প্রার্থীরা, যারা পরীক্ষায় তুলনামূলক ভাল ফল করেছিলেন, তারা বঞ্চিত হয়েছিলেন। এই বিষয়টি নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছিল।
দুর্নীতির অভিযোগ ও প্যানেল বাতিল
দুর্নীতির অভিযোগে এসএসসির ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এই নির্দেশের ফলে ২৫,৭৩৫ জনের চাকরি গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছে এবং ৬ মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। আদালত আরও জানিয়েছিল যে, বাতিল হওয়া প্যানেলের মধ্যে কয়েকজন 'অযোগ্য' (দাগি বা টেন্টেড) হিসেবে চিহ্নিত। তাদের বেতনও ফেরত দিতে হবে। এই 'অযোগ্য'দের নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যোগদানের সুযোগ দেওয়া হবে না।
'অযোগ্য'দের তিনটি মূল শ্রেণি:
- সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরিপ্রাপ্ত: যারা পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিয়েও চাকরি পেয়েছিলেন।
- প্যানেল-বহির্ভূত বা মেয়াদ উত্তীর্ণের পর নিয়োগ: যারা প্যানেলের বাইরে গিয়ে অথবা প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে চাকরি পেয়েছিলেন।
- 'র্যাঙ্ক জাম্প' করে চাকরিপ্রাপ্ত: যারা মেধাতালিকায় পিছিয়ে থেকেও 'র্যাঙ্ক জাম্প' করে অন্যদের টপকে চাকরি পেয়েছিলেন।
তৃতীয় পর্যায়ের এই চাকরিহারারা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল যে, তারা সাদা খাতা জমা দেননি এবং প্যানেলেও তাদের নাম ছিল। পরীক্ষায় দিয়েই তারা চাকরি পেয়েছেন, তাই নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়াতেও তাদের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হোক।
সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়
বুধবার (২১ মে, ২০২৫) এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি ছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং বিচারপতি কেবি বিশ্বনাথনের ডিভিশন বেঞ্চে। আদালত জানিয়েছে যে, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাতে তারা আর হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ ওই নির্দেশে কোনো ভুল ছিল না।
এসএসসির দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছিলেন, তাদের আইনজীবী ফিরদৌস শামিম এবং বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায়েরা আদালতের রায় সম্পর্কে বলেছেন, "অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেনি। র্যাঙ্ক জাম্প করে চাকরি পেয়েছেন, এমন প্রার্থীদের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, র্যাঙ্ক জাম্প করে চাকরি নেওয়াও দুর্নীতি। তারা (র্যাঙ্ক জাম্প করে যারা চাকরি পেয়েছেন) দুর্নীতির অংশ। তাই নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়ায় তারা যোগ দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট।" এই রায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতের কঠোর অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।
চাকরিহারাদের পরিস্থিতি ও মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা
এসএসসি-র ২০১৬ সালের পুরো প্যানেল বাতিল হওয়ায় শুধু শিক্ষকরাই নয়, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মীরাও চাকরি হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২৬ হাজার মানুষ এই রায়ের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। 'র্যাঙ্ক জাম্প' করে যারা চাকরি পেয়েছিলেন, তাদের পরীক্ষায় বসার সুযোগ খারিজ হওয়ার ফলে তারা আরও বিপাকে পড়েছেন।
এদিকে, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আবেদনের ভিত্তিতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা প্রমাণিত দুর্নীতিগ্রস্ত নন, সেইসব শিক্ষকদের চাকরি করার অনুমতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে, গ্রুপ ডি ও গ্রুপ ডি পদে চাকরিহারাদের সম্পর্কে শীর্ষ আদালত কিছু বলেনি, যার ফলে স্পষ্ট যে তারা আর বেতন পাবেন না। এই পরিস্থিতিতে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসএসসির গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি-এর কর্মীদের জন্য ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, "পশ্চিমবঙ্গ শ্রম দফতরের অধীনে পশ্চিমবঙ্গ জীবিকা এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্তর্বর্তী প্রকল্পে গ্রুপ সি ও গ্রু ডি কর্মচারীদের পয়লা এপ্রিল থেকে মাসে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হচ্ছে, গ্রুপ সি ২৫ হাজার, গ্রুপ ডি ২০ হাজার করে অনুদান দেওয়া হবে।" এই ভাতা ঘোষণা চাকরিহারা কর্মীদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় পশ্চিমবঙ্গের এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি কেবল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়াই নয়, বরং নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও একটি মাইলফলক। তবে, এই রায়ের ফলে হাজার হাজার চাকরিহারা মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। সরকার ও আদালতের পরবর্তী পদক্ষেপের উপরই এখন সকলের নজর।
#ssc scam , #bongo bhumi , #supreme court, #west bengal teachers recruitment scam
0 মন্তব্যসমূহ