বাংলাদেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ – সেনার সঙ্গে বিবাদ তীব্র , ইউনুস-পতনের কাউন্টডাউন শুরু
মানুষের ভাষা, বিশেষ প্রতিবেদন :
পূর্ববর্তী বিশ্লেষণগুলির ধারাবাহিকতায় – পূর্ববর্তী নিবন্ধের জন্য দেখুন:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নতুন সংকটের মুখোমুখি, যা আমাদের পূর্ববর্তী বিশ্লেষণগুলিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস, যিনি শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, এখন চরম হতাশা ও চাপের মুখে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন। এটি কেবল তাঁর ব্যক্তিগত অসহায়ত্ব নয়, বরং একটি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার করুণ চিত্র তুলে ধরে, যেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভবিষ্যৎ আবারও প্রশ্নের মুখে।
ইউনুসের অসহায়ত্ব ও ইউনুস-সেনা ক্ষমতার টানাপোড়েন
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কর্তৃক আয়োজিত প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং তার এক দিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কঠোর সতর্কবাণী, ইউনুসের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ছাত্রনেতা এবং ইসলামপন্থীরা ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও সেনা ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে মিছিলের জন্য তরুণদের সংগঠিত করছে। সরকারি বিভাগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী, শুক্রবারের নামাজের পর বড় ধরনের গোলযোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউনুসের এই পদত্যাগের হুমকিকে অনেকে সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে একটি চাল হিসেবে দেখছেন, যিনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী। কারণ, নির্বাচন হলে বাংলাদেশের প্রকৃত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইউনুসের কার্যকাল শেষ হবে। আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা, নারী সংস্কারে বাধা এবং এমনকি মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন ধ্বংস করার মতো ঘটনার পর ছাত্র ও ইসলামপন্থীদের ভিড় বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে, ইউনুস পরিকল্পনায় কোনো ভূমিকা না রাখলেও, তিনি চুপচাপ এর সাথে জড়িত ছিলেন।
গত বছরের ছাত্র নেতৃত্বাধীন কোটা সংস্কার আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়, যার ফলে প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ঢাকা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এই আন্দোলন থেকেই সৃষ্ট ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (NCP) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, ইউনুস বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ ও বিক্ষোভের মধ্যে কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন না বলেই পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন। ইউনুস নাকি বলেছেন, "আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে… আমি এভাবে কাজ করতে পারি না। সব রাজনৈতিক দল কি একটি সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে না?"
সেনা-সরকার সংঘাত ও মিয়ানমার সীমান্ত প্রসঙ্গ
নাহিদ ইসলাম আরও বলেছেন, ইউনুস যদি সমর্থন না পান, তাহলে তাঁর পদে থাকার কোনো যুক্তি নেই। যদি রাজনৈতিক দলগুলো চায় যে তিনি এখনই পদত্যাগ করুন, তাহলে কোনো আশ্বাস না পেলে তিনি কেন থাকবেন? জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে একটি মানবিক করিডর তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে মতবিরোধ চলছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউনুস সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোপনে এই করিডর তৈরির চুক্তি করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
পাকিস্তানের পদাঙ্ক অনুসরণ?
বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের 'বেগিং বোল' (ভিক্ষার ঝুলি) অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশ এখন অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সন্ত্রাসবাদের মদত এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে। যেমনটি আমরা আমাদের পূর্ববর্তী নিবন্ধে স্বখাত-সলিলে বাংলাদেশ : ভারতের চাপে হাঁসফাঁস ইউনুস , সেনার হাতে ক্ষমতা কি সময়ের অপেক্ষা মাত্র ? ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কট্টরপন্থী ইসলামপন্থীদের উত্থান একটি দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে কতটা তলানিতে নামিয়ে দিতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং ঋণের উপর নির্ভরশীল, যা তাদের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যখন বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং সামরিক চাপের জালে জড়িয়ে পড়ে, তখন তার মর্যাদা এক ভিক্ষুকের মতো হয়ে যায়, যা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও কদর্য করে তুলছে।
সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর প্রভাব
এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সবচেয়ে বড় শিকার হলো বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই হিন্দুদের উপর নির্যাতন, সম্পত্তি দখল এবং ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার, যার পেছনে ইসলামপন্থী শক্তি এবং ছাত্র নেতাদের সমর্থন রয়েছে, হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং, কট্টরপন্থী মনোভাবের কারণে হিন্দুদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আমাদের পূর্ববর্তী বিশ্লেষণে আমরা বারবার উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা হিন্দুদের জন্য এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে। এই নতুন সংকটে সেই বিভীষিকা আরও গভীর হয়েছে, যা ভারতের জন্য এক উদ্বেগের কারণ।
বাংলাদেশের এই বর্তমান পরিস্থিতি এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইউনুসের পদত্যাগের হুমকি, সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য – সবকিছুই একটি অস্থিতিশীল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারত, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে, এই পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধুমাত্র আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে না, বরং এটি মানবিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
0 মন্তব্যসমূহ